উঠোন থেকে দোতলার বারান্দায় উঠে এল বিন্ধ্যবাসিনী। আজকাল একটানা সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে আসতে হাঁপ ধরে যায়। খাড়া খাড়া ধাপ। পুরোনো বাড়ি। তবে ঢের মজবুত। বারান্দায় বেতের আরাম চেয়ারে বসে একটু দম নিয়ে নিল সে। সামনে ফিটফাট আকাশ। একেবারে ছবির মতো নীল। তবে এককোণে পাকা করমচার মতো রঙ ধরেছে। বিকেল নামছে। বিন্ধ্যবাসিনী সোজা হয়ে পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল। ষাটের চৌকাঠ পার করেও এখনও তার শরীর টানটান। গড়পড়তা বাঙালি মহিলাদের তুলনায় বেশ লম্বা। তাই হয়ত তাকে একটু দুবলা লাগে। তীক্ষ্ণ চোখ, টিকালো নাক। মাথায় অঢেল চুল এখনও, যেন কবেকার অন্ধকার নিশা। শুধু কালো চুলের মাঝে মাঝে দু’একটা রুপালি রেখা টেনে দিয়েছে বুড়ো বয়েস।
বিকেলে বসে বসে সে শুধু ভাবে। কী ভাবে! ভাবনার কি কোনও হিসেব আছে? আকাশ পাতাল আছে? এই যে বাড়িটা? কোন এক যুবতী বয়েসের উপার্জন। হ্যাঁ, উপার্জন কথাটাই ঠিক ঠিক মানায়। বাকি সব বিচ্ছিন্ন হেঁয়ালি ছাড়া আর কিছু নয়। কিংবা আগাছার লৌকিকতা। তবে জমিদার বাড়ির বউ— এমন তকমাও আদতে মিছে কথা নয় যদিও। বউ ও বউয়ের সীমানার কাছে চৌকাঠ অবধি তো সত্যি। যে যুবতীরর চানঘরে পরপুরুষ! পরপুরুষ কথাটা ভাবলেই আবার থমকে যায় বিন্ধ্যবাসিনী। পুরুষ তো তাঁর একজনই ছিল। চিলের লোভের মতো আর কারও লোভের কাছে কিংবা ভালোবাসার কাছেও তো কোনোদিনও জানু-বিস্তার করে বসেনি সে। না বসবার কোনও সাধ জেগেছিল তার!
বিন্ধ্যবাসিনীর ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। হাসিরও এক এক ধরনের চলন আছে। এক একটা চলমান আলোর মতন।
মুখে হুশহুশ শব্দ করতে করতে নিচ থেকে উঠে আসছে বনবিহারী। বিন্ধ্যবাসিনী শুনতে পেলেন। ঠিক নিচের সিঁড়ির মুখটায় শুয়ে থাকে ধম্ম। বিন্ধ্যবাসিনীর পোষা নেড়ি। কথাটা ভাবলেই হাসির একটা খুচরো ঝুমঝুমি যেন বেজে ওঠে। সেই ঝুমঝুমির শব্দ বিকেলের আলোর আলস্যে মিশে বিন্ধ্যবাসিনীর ঠোঁটের কোণে নেমে আসে। আরও কয়েকজন পোষ্যর মতো ধম্মও এসে জুটেছিল। বিন্ধ্যবাসিনীর ঠিক চোখের সামনেই বেচারা গাড়ি চাপা পড়তে বসেছিল। বিন্ধ্যবাসিনী কোনোক্রমে পায়ের একটা টোকায় তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। বেচারা তখন দুধের শিশু। বটুক তাকে কোলে করে বাড়ি নিয়ে এসেছিল। সেই থেকেই এটা এই বাড়িতে রয়ে গেছে। বিন্ধ্যবাসিনী প্রথমে বুঝতে পারেনি। পরে অবাক হয়েছিল। সারমেয়টি অন্ধ। তার তো কোনোদিন ধম্মকম্মে মতি হয়নি আর হবেও না। যাক, সারমেয় শিশুটির নাম রেখেই যেন কিছুটা ধম্ম হলো। তার মনে তখন একটা চাতুরির হাসি খেলে উঠেছিল কী না, তা আজ আর মনে নেই।
বনবিহারী হুশ হুশ শব্দ করে ধম্মকেই তাড়াচ্ছিল। কুকুর-বেড়াল সে একেবারে পছন্দ করে না। কিন্তু কী করবে! এই বাড়িতে মনিবের লাই পেয়ে পেয়ে এরাই যেন মাথায় উঠে বসে আছে।
বনবিহারীর চেহারাটা উঠোনের কোণে অবহেলার নিমগাছটার মতো। অপুরুষ্ট কান্ড। লিকলিকে ডালপালা। বনবিহারী বেশ ঢ্যাঙা, গায়ে মাংস নেই বলে আরও যেন লম্বা দেখায়। গায়ের রঙ পুরোনো সেগুন কাঠের মতো। সরু সরু হাত-পা। তাতে মোটা মোটা শিরা স্ফিত হয়ে প্রকট হয়ে থাকে। মাথায় এখনও সব চুল কালো। কুচকুচে কালো। তেল চপচপে। তার বয়স ঠিক কত তা তার চেহারা দেখে অনুমান করা যায় না। বিন্ধ্যবাসিনীর মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, বুড়ো বুঝি চুলে রঙ মাখায়।
বনবিহারী সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে হাঁফাচ্ছিল। ঠিক যেন পুরোনো পাবলিক বাস স্টপেজে থামার সময়ে কোঁত পেড়ে পেড়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। খাড়া নাকের পাটা কাঁপছিল। বসন্তের দাগ লাঞ্ছিত অসুন্দর মুখ আর কোটরগত চোখের উপরে ক্লান্তি মেচেতার মতো লেপটে বসে আছে। সবসময়ই থাকে।
বিকেলের আলো কমে এলেও অন্ধকার তেমন জমাট বাঁধেনি যাতে আলো জ্বালতে হয়। বনবিহারী এগিয়ে এসে কিছু বলবে বলে মুখ খুলেছিল।
বিন্ধ্যবাসিনী বিরক্তিতে ভারি গলায় বলল, ‘তোমাকে বার বার বলেছি না, আমার সঙ্গে কথা বলতে আসবার আগে বিড়ি ফুঁকবে না! এই কটু গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না! বলিনি তোমাকে?’
বনবিহারীর চশমার মোটা কাচের ভিতরে চোখদুটি ম্লান হয়ে এলো। মনে হলো পুরোনো বালবের জোর কমে গেছে। সে আমতা আমতা করে কিছু বলতে চেষ্টা করলে, বিন্ধ্যবাসিনী ধমকে উঠল, ‘যাও এখান থেকে। মুখ-টুখ ধুয়ে পরে এসো।’ একটু থেকে আরও বিরক্তির গলায় বলল, ‘আর, হ্যাঁ। বটুককে পাঠিয়ে দাও।’
বনবিহারী ঘাড় গোঁজ করে চলে গেল। বিন্ধ্যবাসিনীর মুখের আগায় তখনও কয়েকদানা বিরক্তি যেন বালির মতো কিচ কিচ করছিল। বিরক্তির সেই দানাগুলিকে গলাধঃকরণ করে সে মনে মনে ভাবল, বনবিহারীর উপরে এতো রাগ কেন!
বনবিহারী তো আর আজকের লোক নয়। সেই কিরাতকান্তর আমল থেকে আছে। এই বংশের অনেক রহস্য সে জানে। অবশ্য এটাও তো ঠিক এত কথা জানে বলেই না এখনও এখানে থাকতে পারছে বনবিহারী! না হলে কবেই তাকে লাথি মেরে দূর করে দিত বিন্ধ্যবাসিনী।
বটুক উপরে উঠে এসে বারান্দার আলোটা জ্বেলে দিল। বটুক অনেক পরে এসেছে এ বাড়িতে। তবে তাও কম দিন নয়। তার চেহারা বেঁটেখাটো, তবে শক্তপোক্ত। মাথায় যৌবনের মিঠুন চক্রবর্তীর মতো চুল। চুলের প্রতি বেশ যত্ন তার।
তবে বটুকের আর এখন সেই সিনেমা প্রেম নেই। কপালে তিলক কেটে সে বোষ্টম হয়েছে। রাত হলে দারোয়ান রামপিয়ারীর সঙ্গে বসে এক গ্লাস সিদ্ধি খেয়ে খোল নিয়ে বসে। ভাবের আবেশে আকাশ-পাতাল হয়ে বটুক গান গায় আর রামপিয়ারী তাল দেয়। বটুকের গলাটা ভালো বলে বিন্ধ্যবাসিনী তাকে পাত্তা দেয়। তবে বিন্ধ্যবাসিনীর মনে হয় বটুকের গলায় যেন দিন দিন কেমন একটা মেয়েলি ভঙ্গি এসে যাচ্ছে। বটুক বরাবরই একটু মেয়ে ন্যাংড়া গোছের। তা সত্ত্বেও বিন্ধ্যবাসিনীর মনে হয়, তার মেয়ে ন্যাংড়া আচরণ বাড়ছে দিনে দিনে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। তবে বিন্ধ্যবাসিনী তাদের ধম্মে-কম্মে বাধা দেয় না কখনও, ওরা যা নিয়ে আছে থাকুক।
আলোটা জ্বলে উঠতে বিন্ধ্যবাসিনী যেন চমকে উঠল। হঠাৎ জ্বলে ওঠা আলোর কেমন একটা সুচি তীব্রতা থাকে, তা অন্ধকারের গায়ে বিঁধে যায় হাজার সূঁচের মতো। বিন্ধ্যবাসিনীর শরীর যেন সেই আলোর হূলস্পর্শে চমকিত হয়ে উঠল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল বটুক। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ রে, সত্য কোথায়?’
‘সত্যদাদা সেই দুপুরে বেরিয়ে গেছে। তারপরে আর ফেরেনি।’
বিন্ধ্যবাসিনী এক মুহূর্ত কিছু ভাবল। যে কয়জন জীবিত প্রাণীর প্রতি এখনও তার মায়া রয়ে গিয়েছে, সত্য তাদের মধ্যে একজন। জীবন যত প্রাচীন হয়েছে তত নিজের থেকে একটু একটু করে মায়া বর্জন করে সে ঋজু হয়েছে। মায়া একটা খেলনা, জীবন তাকে নিয়ে শুধু অবহেলায় খেলা করে। খেলতে খেলতে নিরর্থক পিছুটান অর্জন করে। বিন্ধ্যবাসিনী সেই সব হেলায় বর্জন করে ক্রমশ সুস্থির হয়েছে।
আনমনা হয়ে হাঁটা শুরু করে সে বটুককে বলল, ‘সত্য ফিরে এলে আমার কাছে পাঠিয়ে দিস তো।’
বটুক ঘাড় কাত করে টানা বারান্দার মাঝামাঝি চলে এসে আর একটা আলো জ্বেলে দেয়। আলো জ্বেলে সে বারান্দার দূর প্রান্তের দিকে এগিয়ে যায়। বিন্ধ্যবাসিনী ঘাড় ঘুরিয়ে বটুককে দেখল। তাঁর মনে হলো, বটুকের পায়ের সঙ্গে অন্ধকার যেন ক্রমশ গুটিয়ে গুটিয়ে আলোর দিকে সরে যাচ্ছে। ঠিক ততোধিক এক নিস্পৃহ আবেশে কিছুটা অন্ধকার বারান্দার রেলিঙের দিকে ঝুঁকে আছে। বিন্ধ্যবাসিনী বিস্ময়ে ঘাড় ফিরিয়ে নেয়। এমন এক বায়োস্কোপ যে তার স্মৃতির কাছে জেগে উঠবে তা সে ভেবে উঠতে পারে না।
Customers' review
Reviews
Be the first to review ""