মুষ্টিমেয়র ক্ষমতা রক্ষা ও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির জন্য আগ্রাসী রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে ধর্মপ্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সম্পর্ক কাছাকাছি আমাদের দেশে সেই মধ্যযুগ থেকেই। শাসকের ভাষা, শাসকের ধর্ম, শাসকের অনুশাসন সমাজজীবনের সদরে–অন্দরে নিয়ামক শক্তি হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছে মধ্যযুগ থেকে বার বার। ক্ষমতাকেন্দ্রের পরিবর্তনের ফলে সমাজের ধর্ম–অর্থ–কাম–মোক্ষ, সবই মুচড়ে বদলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছো। কিছুটা সামাজিক অনুশীলনের দ্বারা আর বেশিরভাগটাই রাষ্ট্রীয় প্রভুদের বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। এই মূলসূত্রেই অভিজিৎ সেনের উপন্যাস ‘ধর্মায়ুধ’।
বাবা: রাজা গণেশ। ছেলে: জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ। এরকম অদ্ভুত ঘটনাই পাওয়া যায় ইতিহাসে। রাজা গণেশ ও তাঁর পুত্রদের মিলিত শাসনকাল পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয় দশক।
উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে রাজা গণেশের সিংহাসনে আরোহণ ও তদপরবর্তী ঘটনা পরম্পরায় তার ছেলে যদুর ধর্মান্তরকে কেন্দ্র করে। উপন্যাসের ভূগোল গৌড়কে কেন্দ্র করে ভাতুড়িয়া পর্যন্ত আবর্তিত। উপন্যাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রাজা গণেশের মন্ত্রী—নাড়িয়াল। যিনি বৌদ্ধ-অবশেষ। সেই বৌদ্ধ ধর্ম, কয়েকশো বছরেই হিন্দুদের আক্রমণে যারা বিলুপ্তপ্রায় হয়েছে, আবার পরে হিন্দুধর্মে মিশেও গেছে। সেই বৌদ্ধ-অবশেষ নাড়িয়ালকে ‘হিন্দু রাজ্য’ গঠনের স্বপ্নে রাজা গণেশকে বিভোর করে রাখতে হয়। সে কি শুধু ধর্মরক্ষা? না বোধহয়, তা শুধু ধর্মরক্ষা হয়ে থাকে না, তাতে মিশে থাকে সিংহাসন আর ক্ষমতা–এমনকি অর্থসম্পর্কও। ধর্ম শুধু ব্যবহৃত হয় আয়ুধ আর অজুহাত হিসেবে। তবু রাজা তো কেবল সিংহাসন নয়।—বিরোধ আসতে থাকে সারা বাংলা জুড়ে লোকায়ত মুসলিম দরবেশদের কাছ থেকে। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামজীবনের সঙ্গে রাজধানীর সাংস্কৃতিক বিচ্ছেদ এর একটা কারণ বটে। সে বিরোধ ঘনিয়ে ওঠে সেই ধর্মকে কেন্দ্র করেই। ইব্রাহিম শর্কির হাত থেকে সিংহাসন বাঁচাতে যুবরাজ যদুকে ধর্মান্তরিত করে সিংহাসনে বসানোর এক বছরের মাথাতেই আবার নিজে রাজা হয়ে বসলেন গণেশ। আয়োজন হতে থাকলো জালালুদ্দিনের পুনর্ধর্মান্তকরণের। সেই ধর্মান্তকরণের জন্য ব্রাহ্মণবিধান অনুযায়ী রাজা গণেশকে বিপুল অর্থ ব্যয় করে সোনার গাভী নির্মাণ করতে হয়েছে। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণসমাজের মাথাকে খুশি করার জন্যই। যদু প্রশ্ন করেছেন, সারা বাংলায় এত লোক হিন্দুধর্মের জাতিভেদের অত্যাচারে ধর্মান্তরিত হয়েছেন, কত মণ সোনা ব্রাহ্মণদের দিয়ে তাদের ধর্মান্তকরণ করবেন রাজা গণেশ? নাকি সিংহাসনে বসার সময় পূর্ববর্তী শাসককে যেভাবে জলে ডুবিয়ে হত্যা করেছিলেন রাজা গণেশ, ‘হিন্দুরাজ্য’ গঠনের জন্য এক্ষেত্রেও তাই করবেন?
কারণ হিন্দু ধর্মে যাওয়ার কোনো সোজা পথ তো ব্রাহ্মণরা রাখেননি। কেন রাখেননি?
ঠিক এক সরণিতে এসে মিলে যাচ্ছে অর্থসম্পর্ক আর ক্ষমতা। আয়ুধ কিন্তু সেই একটাই। ধর্ম। ‘ধর্মায়ুধ’।
Customers' review
Reviews
Be the first to review ""